কালো পাহাড়ের আলো


image

হযরত বিলাল।

হাবশী ক্রীতদাস। গায়ের রং কুচকুচে কালো।

কিন্তু মানুষের বাইরের চেহারাটাই আসল চেহারা নয়। ভেতরটাই আসল। ভেতর অর্থাৎ হৃদয়টা যার ধবধরে পরিষ্কার সেই কেবল সুন্দর মানুষ।

বিলাল কালো হলে কি হবে!

তাঁর হৃদয়টি ছিল চাঁদের মতো পরিষ্কার। জোছনার মতো সুন্দর। সূর্যের মতো উজ্জ্বল। আর তাঁর বুকে ছিল বজ্রের সাহস।

সে সাহস ছিল সমুদ্রের মতো বিশাল। পর্বতের মতো অনড়।

কালো মানুষের ভেতর যে এত রূপ, এত সৌন্দর্য থাকতে পারে তা বিলালকে না দেখলে বোঝাই যায় না। বিলালেল এই সুন্দর্যের আসল রহস্য হলো- তাঁর বিশ্বাস।

তাঁর গভীর বিশ্বাস এবং ভালেঅবাসা ছিল আল্লাহর রহমতের ওপর। আল্লাহর ওপর নবীর (স) ওপর।

তাঁর সকল আস্থা ছিল আল্লাহর রহমতের ওপর। আল্লাহর শক্তির ওপর।

আর নবীকে (স) তিনি ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। তাঁর সে ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। এতটুকু কৃত্রিমতা ছিল না। তাই ক্রীতদাসহয়েও বিলাল মনিবের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে নবীর (স) ডাকে সাড়া দিলেন।

ইসলাম গ্রহণ করে তিনি পরম তৃপ্তি এবং প্রশান্তি লাভ করলেন।

কেনা গোলাম হলে কী হবে?

মনিব তো কেবল একটি মানুষকে টাকা দিয়ে কিনতে পারে। সে তো আর মানুষের হৃদয় কিনতে পারে না।

বিলালের মনটাও তাঁর মনিব কিনতে পারেনি। এজন্যে তিনি স্বাধীন ছিলেন মনের দিকদিয়ে। আর স্বাধীন থেকেই তিনি তাঁর একমাত্র হৃদয়টা তুলে দিয়েছিলেন আল্লাহর হাতে। ইসলামের খেদমতে। নবীর (স) ভালোবাসায়।

চুপে চুপে নয়। একেবারে সবার সামনে। প্রকাশ্যে তিনি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলেন।

বললেন, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভু নাই। ইসলাম একমাত্র জীবন বিধান। আর নবী (স) হলেন আল্লাহর প্রেরিত মহান পুরুষ। যিনি সত্যের আলো নিয়ে আমাদের মাঝে এসেছেন। তিনি এসেছেন সত্যের বারতা নিয়ে। মানুষের মুক্তির জন্যে।

হাবশী ক্রীতদাস বিলাল!

কুচকুচে কালো মানুষটির এঋ দৃঢ়কণ্ঠের আওয়াজ তার মনিব শুনতে পেল। শুনতে পেল কাফেররাও। তারা ক্রোধে ফেটে পড়লো। বললো,

কেনা গোলাম- কালো মানুষের এতবড় সাহস! এর পরিণাম বড় ভয়ানক।

বিলাল তাদের কথা যেন, শুনতেই পাননি। কারণ তিনি তো জানেন, দুর্বলদের ওপর সবলরা সব সময়ই অত্যাচার করে। জুলুম এবং নির্যাতন চালায়। এ আবার নতুন কী?

কাফেররা বললো, এখনো তুমি মুহাম্মদের (স) পথ থেকে ফিরে এসো বিলাল। তা না হলে তোমার কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে। অনেক কষ্ট আছে।

হেসে উঠলেন বিলাল।

কালো মানুষের ভেতর থেকে ছিটকে পড়লো হাসির তুফান। বললেন, আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? তোমরা কি জানো, যে হৃদয় একমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর নবীকে (স) ভালোবাসে, সে হৃদয় দুনিয়ার আর কাউকেই ভয় করে না! পরোয়া করে না! তোমরা আমাকে কিসের ভয় দেখাও? তোমরা আমাকে কী করতে পারো? মারবে? মারতে পারো। কিন্তু আমার বিশ্বাসকে তো আর কেড়ে নিতে পারবে না! না, কখনোই তা পারবে না।

গোলামের মুখে এই দুঃসাহসের কথা শুনে কাফেররা চরমভাবে ক্ষেপে গেল। জ্বলে উঠলো তাদের পাষণ্ড হৃদয়। তারা শুরু করলো তার ওপর পাশবিক নির্যাতন।

অত্যাচারী আবু জেহেল। মস্তবড় এক কাফেল। বিশাল তার দলবল। আবু জেহেলল হুকুমে বিলালের ওপর ক্রমাগত চলেছে নির্যাতন আর নিষ্ঠুরতম অত্যাচার।

কাফেররা তাকে আবের আুগনের মতো উত্তপ্ত মরুভূীমর বালির ওপর নির্দয়ভাবে মারতো।

পাথরের কুঁচি এবং জ্বলন্ত আগুনের ওপর তাঁকে শুইয়ে দিত।

তাঁর গলায় দড়ি বেঁধে অবুঝ শিশুদের হাতে কাফেররা তুলে দিত।

শিশুরা বোঝে না। তারা খেলার ছলে বিলালকে টেনে হেঁচড়ে ছাগলের মতো করে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতো মক্কার অলিতে গলিতে। ঝাঁঝরা হয়ে যেত বিলালের শরীর। তাঁর দেহ থেকে ঝরে ঝরে পড়তো টাটকা রক্ত।

আর আবু জেহেল?

সে নিজ হাতে বিলালকে শাস্তি দিল। তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিত। তারপর বিলালের পিঠের ওপর পাথরের বড় বড় চাক্কি চাপিয়ে দিত।

মরুভূমির মধ্যে সূর্যের চোখ থেকে যখন আগুন বের হয়, ঠিক সেই সময়ে আবু জেহেল বিলালের ওপর এভাবে পশুর চেয়েও জঘন্য আচরণ করতো।

গরম বালিতে বিলালের বুক পুড়ে যেত। পিছের ওপর ভারী পাথরে চাপে তিনি বালির মধ্যে দেবে যেতেন। পিপাসায় বুক গলা শুকিয়ে যেত। পিপাসায় এবং যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করতেন।

বিলালের কষ্ট দেখে হায়েনার মতো হেসে উঠতো নরপশু আবু জেহেল। বলতো,

এখনো সময় আছে বিলাল, মুহাম্মদের (স) আল্লাহ থেকে তুমি ফিরে এসো। তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর কোনো অত্যাচার করা হবে না তোমার ওপর।

কিন্তু যিনি একবার আল্লাহকে ভালোবেসে তাঁর সত্য দীনকে গ্রহণ করেছেন, তিনি মানুষের নির্যাতনের ভয়ে পরাজয় বরণ করবেন কিভাবে?আল্লাহর প্রেমের কাছে, নবীর (স) প্রেমের কাছে এই জুলুম অত্যাচার তো খুবই তুচ্ছ।

দুঃসাহসী বিলাল!

পর্বতের মতো যাঁর বিশ্বাস। তিনি তার বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়লেন না। বরং আবু জেহেলর সকল অত্যাচারের মধ্যেও তিনি হাসি মুখে জবাব দিলেন,

আল্লাহ আহাদ। আল্লাহু আহাদ।

বিলালের জবাবে পাপিষ্ঠ আবু জেহেল আরও বেশি ক্ষেপে যেত। আর সেই সাথে বেড়ে যেত তার অত্যাচারের মাত্রা।

কখনো বা গরুর কাঁচা চামড়ায় ভরে, আবার কখনো বা লোহার বর্ম পরিয়ে বিলালকে মরুভূমির মধ্যে- যখন দোজখের মতো সূর্যের মতো তেব, সেই সময় বসিয়ে রাখতো। প্রাণবায় বেরিয়ে যায় যায়, এমন সময় তাঁকে পাপিষ্ট আবু জেহেল বলতো,

এখনো ফিরে এসো বিলাল। আল্লাহ এবং মুহাম্মাদের (স) পথ থেকে ফিরে এসো। আমরাতোমাকে ছেড়ে দেবো।

পর্বতের মতো অনড় বিলাল।

শত অত্যাচারেও তিনি তার বিশ্বাস থেকে ফিরে আসেননি। তখনো, সেই ক্লান্ত, মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়েও বিলাল হাসি মুখে উচ্চারণ করেছেন,

আল্লাহু আহাদ। আল্লাহু আহাদ।

ইসলাম গ্রহণ করার কারণে বিলালের ওপর যে রকম অত্যাচার-নিপীড়ন নেমে এসেছিল তা এতই মর্মান্তিক যে এখনো মুখে সে নির্যাতনের কথা উচ্চারণ করতেও গায়ের পশম মুহূর্তেই লাফিয়ে ওঠে।

অথচ কাফেরদের অত্যাচারের মাত্র যত বেড়ে যেত, ততোই বেড়ে যেত বিলালের সহ্যশক্তি। বেড়ে যেত তার ধৈর্য। সেই সাথে বেড়ে যেত বিলালের আল্লাহ এবং তাঁর নবীর (স) ওপর অপরিসীম প্রেম এবং ভালোবাসা।

একমাত্র প্রেম এবং ভালোবাসার জন্যে মানুষ সব ত্যাগই স্বীকার করতে পারে।

বিলাল ছিলেন এই চরিত্রের জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি ছিলেন সত্যের এক উজ্জ্বল প্রেমিক পুরুষ।

তিনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে (স) ভালোবেসে যাবতীয় ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন হাসি মুখে।

আল্লাহর সন্তুষ্টির অর্জন, তাঁর দীনকে প্রতিষ্ঠা করা এবং নবীর (স) সাহচর্য ও ভালোবাসা লাভ করাই ছিল বিলালের একমাত্র উদ্দেশ্য।

একদিন বিলালের ওপর অকথ্য নির্যাতনের বেদনাদায়ক দৃশ্য নিজের চোখে দেখলেন হযরত আবু বকর। দেখে তিনি শিউরে উঠলেন। অনেক অর্থের বিনিময়ে গোলাম বিলালকে আজাদ করে দিলেন হযরত আবু বকর।

নবীকে দারুণ ভালোবাসতেন বিলাল। নবী (স) তাকে খুবই ভালোবাসতেন।

কালো হলে কী হবে?

বিলালের হৃদয়ে যে সত্যেল সূর্য ছিল- তাতো ছিল অত্যন্ত প্রোজ্জ্বল। সে আলোর শিক্ষা বিলালেরকালো চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতো। মেঘ ফুঁড়ে সূর্য যেভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেইভাবে।

বিলালকৈ অত্যন্ত পছন্দ করতেন নবী (স)। তিনি বললেণ, বিলাল আযান দাও। আমরা নামায আদায় করবো।

বিলাল রাসূলের (স) নির্দেশে আযান দিলেন।

বিলালই প্রথম আযানদাতা। অর্থাৎ প্রথম মুয়াজ্জিন।

বিলালের উচ্চ কণ্ঠের আযানের ধ্বনিতে চারদিকে মুখরিত হয়ে যেত। চারদিকে সাড়া সাড়া রব পড়ে যেত। তার আযান শুনে কোনো মুসলমানই আর ঘরে বসে থাকতে পারতেন না। পুরুষ, নারী, যুবক, বৃদ্ধ এমনকি শিশুরা পর্যন্ত বিলালের আযান শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন।

হযরত বিলাল!

এক সময়ের হাবশী ক্রীতদাস!

সেই কালো মানুষটি ছিলেন সত্যের পক্ষে অত্যন্ত বিনয়ী। আর অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে ছিলেন অনড় পর্বত।

বিলাল- কেবল একজন কালো মানুষের নাম নয়। বরং সত্য ও বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত দুর্ভেদ্য এক কালো পাহাড়ের নাম-

হযরত বিলাল!

যে পাহাড় থেকে সত্য, বিশ্বাস এবং সাহসের আলো কেবলই ঝরে ঝরে পড়তো।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.