রাসূল (ছাঃ) -এর মধ্যস্থতায় কা’বা পুনর্নির্মাণ  


wpid-img_20150513_105827.jpg

কা’বা গৃহ পুনঃনির্মাণ ও মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা:
আল-আমীন মুহাম্মাদ -এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরায়েশ নেতাগণ কা’বাগৃহ ভেঙ্গে পুনঃনির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে গড়া ন্যূনাধিক আড়াই হাযার বছরের স্মৃতিসমৃদ্ধ এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনঃনির্মাণের পবিত্র কাজে সকলে অংশ নিতে চায়।
ইবরাহীমী যুগ থেকেই কা’বা গৃহ ৯ হাত উচু চার দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর ছিল, যার কোন ছাদ ছিল না। কা’বা অর্থই হল চতুর্দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির তীব্র স্রোতের আঘাতে কা’বার দেওয়াল ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। অধিকন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঐ সময় ঘটে যায়, যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি এবং যা কা’বা পুনঃনির্মাণে প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করে। ঘটনাটি ছিল এই যে, কিছু চোর দেওয়াল টপকে কা’বা গৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়। অতঃপর কা’বা গৃহ পুনঃনির্মাণের উদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে স্থির করেন যে, কারু কোনরুপ হারাম মাল এই নির্মাণ কাজে লাগানো যাবে না। কোন কোন গোত্র কোন পাশের দেওয়াল নির্মাণ করবে সে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু কে আগে দেওয়াল ভাঙ্গার সূচনা করবে? অবশেষে ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ মাখ্যূমী সাহস করে প্রথম ভাঙ্গা শুরু করেন। তার্পর সকলে মিলে দেওয়াল ভাঙ্গা শেষ করে ইবরাহীম (আঃ) -এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙ্গা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে “বাকুম” নামক জনৈক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু গোল বাধে দক্ষিন-পূর্ব কোণে “হাজারে আসওয়াদ” স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তারক্তিতে গড়াবার আশংকা দেখা দিল। এই সময় প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযূমী প্রস্তাব করলেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম হারাম শরীফে প্রবেশ করবেন, তিনি এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল। আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, সকালে সবার আগে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সবার প্রিয় আল-আমীন। তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো- “ে যে মুহাম্মাদ, এ যে আল-আমীন, আমরা সবাই তার উপরে সন্তুষ্ট”। তিনি ঘটনা শুনে সহজেই মিমাংসা করে দিলেন। তিনি একটা চাদর চাইলেন। অতঃপর সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে “হাজারে আসওয়াদ”-টি তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সকলে মিলে চাদরের চারপাশ ধরুন অতঃপর উঠিয়ে নিয়ে চলুন। তাই করা হল। কা’বার নিকটে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেকে দিলেন। সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মাদের তারিফ করতে করতে চলে গেল। আরবরা এমন এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল, যা ২০ বছরেও শেষ হত কি-না সন্দেহ। এ ঘটনায় সমগ্র আরবে তার প্রতি ব্যপক শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো। নেতাদের মধ্যে তার প্রতি একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রমবোধ সৃষ্টি হল।
কিন্তু নির্মাণের এক পর্যায়ে উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু আদী বিন কা’ব নিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের কমতি থাকায় ব্যর্থ হয়। ফলে মূল ভিতের ঐ অংশের প্রায় ৬ হাত জায়গা বাদ রেখেই দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। যা হাত্বীম বা পরিত্যক্ত নামে আজও ঐভাবে আছে। সেকারণ হাত্বীমের বাহির দিয়েই ত্বাওয়াফ করতে হয়, ভিতর দিয়ে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের পরে ঐ অংশটুকু কা’বার মধ্যে শামিল করে পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নওমুসলিম কুরায়েশরা সেটা মেনে নেবে না ভেবে পুনর্নির্মাণ করেননি। পরে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) -এর খেলাফত কালে ৬৪ হিজরীতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছঃ) -এর উক্ত ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মক্কা অবরোধ কালে ৭৩ হিজরীতে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) শহীদ হলে কা’বা পুনর্নির্মান করা হয় এবং পূর্বের ন্যায় হাত্বীমকে বাইরে রাখা হয়। যা আজও আছে। অথচ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) যেটা করেছিলেন, সেটাই সঠিক ছিল। কিন্তু অন্ধ রেওয়াজ পূজার জয় হল।
কা’বার আকৃতি:
কুরায়েশগণ কতৃক নির্মিত কা’বা (যার রুপ বর্তমানে রয়েছে), দেওয়ালের উচ্চতা ১৫ মিটার, ৬টি স্তম্ভের উপর নির্মিত হয় এবং দরজার নিচের চৌকাঠ ২ মিটার উচ্চতায়, যাতে তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে না পারে। অথচ রাসূলের ইচ্ছা ছিল, হাত্বীমকে অন্তরভুক্ত করে মূল ভিতের উপর কা’বা গৃহ নির্মাণ করবেন। যা মাটি সমান হবে এবং যার পূর্ব দরজা দিয়ে মুসল্লী প্রবেশ করবে ও ছালাত শেষে পশ্চিম দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উচুতে দরজা নির্মাণ করে যাতে তাদের ইচ্ছার বাইরে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। খালা আয়েশা (রাঃ) -এর নিকট এ হাদীছ শোনার পর হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নু যুবায়ের (রাঃ) স্বীয় খেলাফত কালে ৬৪ হিজরী সনে কা’বা গৃহ ভেঙ্গে রাসূলের ইচ্ছানুযায়ী পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু তিনি শহীদ হওয়ার পর ৭৩ হিজরী সনে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তা পুররায় ভেঙ্গে আগের মতো নির্মাণ করেন। যা আজো রয়েছে। পরবর্তীতে আব্বাসীয় খলিফা মাহদী ও হারুণ এটি পুনর্নির্মাণ করে রাসূলের ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক (রহঃ) তাদেরকে বলেন, আপনারা কা’বা গৃহকে বাদশাহদের খেল-তামাশার বস্তুতে পরিণত করবেন না [১]। ফলে আজও কা’বা গৃহ একই অবস্থায় রয়েছে। ইবরাহীমী ভিত্তিতে আজও ফিরে আসেনি। শেষনবীর আকাংখাও পূর্ণ হয়নি।
[১] ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১২৭-২৮; ঐ, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/২৫৩।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.