উভয়ের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে এরূপ চুক্তি জায়েয (বুখারী হা/২২৪০)। তবে সবকিছু সুনির্দিষ্ট হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেলেন, ‘যদি কেউ অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয় করে তবে সে যেন নির্ধারিত পরিমাপে, নির্ধারিত পরিমাণে এবং নির্ধারিত মেয়াদে তা করে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৮৮৩ ‘ক্রয়–বিক্রয়’ অধ্যায়)। এক্ষেত্রে যেন কেউ যুলুমের শিকার না হয় সেদিকেও অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত’ (নিসা ৪/২৯)।
জনৈক বক্তা বলেন, মুসলিম উম্মাহর আমলগুলো প্রতিদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থাপন করা হয়- একথা কি ঠিক?
উক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। কেননা ‘তোমাদের আমলসমূহ আমার নিকটে পেশ করা হয়’ মর্মে যে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ (বাযযার, সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৭৫)। এ মর্মে কেবল এতটুকুই পাওয়া যায় যে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমার সামনে আমার উম্মতের ভাল-মন্দ সব আমল পেশ করা হ’ল। আমি তাদের নেক আমলের মধ্যে একটি দেখলাম রাস্তা হ’তে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে ফেলা। আর তাদের মন্দ কর্মসমূহের মধ্যে একটি দেখলাম মসজিদে ফেলা সর্দি, যা মাটিচাপা দেয়া হয়নি’ (মুসলিম হা/৫৫৩, মিশকাত হা/৭০৯)।
আল্লাহ তা‘আলা কয়টি জিনিস নিজের হাতে রেখেছেন এবং সেগুলো কি কি?
আল্লাহ তা‘আলা পাঁচটি জিনিস নিজের হাতে রেখেছেন, যা অন্যকে অবহিত করেননি। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকটেই রয়েছে (১) ক্বিয়ামতের জ্ঞান। (২) আর তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং (৩) তিনিই জানেন মায়ের গর্ভাশয়ে কি আছে। (৪) কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং (৫) কেউ জানে না কোন মাটিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সকল বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (লোকমান ৩১/৩৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘গায়েবের চাবিকাঠি পাঁচটি। আল্লাহ ব্যতীত যা কেউ জানে না। অতঃপর তিনি অত্র আয়াতটি পাঠ করেন’ (বুখারী হা/৪৬২৭)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এই পাঁচটি বস্ত্ত আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। এগুলি না জানেন নিকটবর্তী কোন ফেরেশতা, আর না জানেন কোন নবী-রাসূল। অতএব যে ব্যক্তি এগুলির কিছু অংশ জানে বলে দাবী করবে, সে ব্যক্তি কুরআনকে অস্বীকার করবে। কেননা কুরআন তার বিপরীত বক্তব্য প্রদান করেছে (কুরতুবী, লোকমান ৩১/৩৪ আয়াতের তাফসীর)।
আমার আশপাশের সমাজ শিরক-বিদ‘আতে পূর্ণ। কিভাবে কাজ করলে আমি এসব মুকাবিলা করতে সক্ষম হব?
প্রথমতঃ নিজে শিরক-বিদ‘আতসহ দ্বীনের মৌলিক বিধি-বিধান সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জন করতে হবে। অতঃপর শিরক-বিদ‘আতের পরিচয় ও ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সাধ্যমত অবহিত করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হ’তে হবে। তাই বেশী বেশী এলাহী মদদ কামনা করতে হবে এবং হিকমত, ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে দাওয়াতী কাজ করতে হবে। আর সহমর্মী কিছু ভাই একত্রিত হওয়া সম্ভব হ’লে জামা‘আতবদ্ধ তথা সংঘবদ্ধ হ’তে হবে, যাতে দাওয়াতী কর্ম সুশৃংখল ও শক্তিশালীভাবে পরিচালিত হ’তে পারে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে’ (তিরমিযী হা/২১৬৬, সনদ ছহীহ)।
সম্প্রতি দেশে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ নামে যে মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। এটা শরী‘আতসম্মত কি?
এটি জায়েয হবে না। কারণ এতে হারাম সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে কে কার দুধ পান করবে সেটি জানা যাবে না। তাই অজ্ঞাতসারে দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ হতে পারে। আর ইসলামে দুধসম্পর্কীয়দের সাথে বিবাহ হারাম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কেননা দুধ পানের সম্পর্ক দ্বারা ঐসব লোক হারাম হয়ে যায় যারা রক্ত সম্পর্ক দ্বারা হারাম হয় (বুখারী হা/২৬৪৫; মুসলিম হা/১৪৪৫)। ১৯৮৫ সালে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, এ ধরনের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হারাম (ওয়ালীদ আস–সাঈদান, আল–ইফাদাতুশ শারঈয়াহ ফী বা‘যিল মাসাইলিত তিবিবইয়াহ ১/২৭০)। তবে নবজাতকের জীবন রক্ষার্থে যদি এরূপ ব্যাংকের একান্ত প্রয়োজন দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে দুধ পৃথক পৃথকভাবে সংরক্ষিত হলে এবং দাতা ও গ্রহীতার পরিচয় সুস্পষ্ট থাকলে তা জায়েয হবে ইনশাআল্লাহ (বিস্তারিত দ্রঃ ড. জাবের ইসমাঈল, বুনূকুল হালীব ফী যূইল ফিক্বহিল ইসলামী, মাজাল্লাতুল উরদুনিইয়াহ, ৯ম সংখ্যা, ২০১৩)।
জনৈক ব্যক্তির দুই লক্ষ টাকার একটি গরু আছে। গরুটি অসুস্থ হ’লে তার পিতা মানত করে যে, এটি সুস্থ হ’লে কুরবানী করবে। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর ছেলে এখন রাযী নয়। এক্ষণে পিতার করণীয় কী?
গরুটির মালিক যদি পিতা হন, তবে তার জন্য উক্ত মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব। আর যদি তিনি মালিক না হন, তাহ’লে উক্ত মানত কার্যকর হবে না। কারণ যে সম্পদে ব্যক্তির মালিকানা নেই সেই সম্পদের উপর মানত করা যায় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষ যে বস্ত্তর মালিক নয়, এমন বস্ত্তর মানত আদায় করা তার উপর যরূরী নয়’ (বুখারী হা/৬০৪৭; মুসলিম হা/১৬৪১; মিশকাত হা/৩৪১০)। আর যেহেতু এই ধরনের মানত সংঘটিত হয় না। সেকারণ এতে কোন কাফফারাও দিতে হবে না (ইমাম শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ২/২৮০; নববী, আল–মাজমূ‘ ৮/৪৫২)।
ইমামের সাথে ছালাতরত অবস্থায় ঘুমের কারণে আমার একটি সিজদা ছুটে যায়। এক্ষণে আমার করণীয় কি?
রুকূ-সিজদা ছালাতের রুকন। আর রুকন তরক করলে ছালাত বাতিল হয়। তাই এরূপ অবস্থায় এক রাক‘আত অতিরিক্ত আদায় করতে হবে এবং সহো সিজদা দিতে হবে (উছায়মীন, শারহুল মুমতে‘ ৩/৩৭১–৭২; আব্দুল্লাহ বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/২৭৭)।
সন্তান না নেওয়ার জন্য কয়েক বছর যাবৎ নিয়মিতভাবে প্রচলিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় কোন বাধা আছে কি?
স্ত্রী ও সন্তানের স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় কয়েক বছর নয়, সাময়িক জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩১৮৪)। কিন্তু সংসারকে সচ্ছল করার নিয়তে তথা দারিদ্রে্যর ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ। কেননা রূযীর মালিক আল্লাহ। আল্লাহ বলেন, ‘দারিদ্রে্যর ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানকে হত্যা কর না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই খাদ্য প্রদান করে থাকি’ (ইসরা ১৭/৩১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা প্রেমময়ী ও অধিক সন্তান দায়িনী নারীকে বিবাহ কর। কারণ আমার উম্মতের সংখ্যা বেশী হওয়া আমার গৌরবের কারণ’ (আবূদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩০৯১)। তবে কোন অবস্থাতেই স্থায়ীভাবে জন্মনিরোধ অর্থাৎ লাইগেশন, ভ্যাসেকটমী ইত্যাদি পদ্ধতি গ্রহণ করা যাবে না। রাসূল (ছাঃ) পুরুষকে খাসী হ’তে নিষেধ করেছেন (বুখারী হা/৪৭৮৬–৮৭; মিশকাত হা/৩০৮১)।
টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু ছালাত শুরু হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় কোনটিকে অগ্রাধিকার যরূরী হবে?
এমতাবস্থায় টয়লেটের কাজ সম্পন্ন করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘খাদ্য উপস্থিত হ’লে ছালাত নেই এবং পেশাব-পায়খানার চাপ থাকলে কোন ছালাত নেই’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১০৫৭)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘ছালাত শুরুর প্রাক্কালে তোমাদের কারো যদি পেশাব-পায়খানার চাপ হয়, তবে সে যেন প্রথমে পায়খানার প্রয়োজন সম্পন্ন করে (আবুদাঊদ হা/৮৮; বায়হাক্বী হা/৪৮০৮, সনদ ছহীহ)। অন্যত্র এসেছে, আবু উমামাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) পেশাব-পায়খানার চাপ নিয়ে ছালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন (আহমাদ হা/২২২০৬; ইবনু মাজাহ হা/৬১৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৮৩২)। তবে ছালাতের খুশু-খুযূ বিনষ্ট হবে না, এমনটি হ’লে ছালাত বাতিল হবে না (ইবনু কুদামা, মুগনী ১/৪৫০)।
আমার একজন বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ট হিন্দু বন্ধু আছে। তার সাথে আমার আন্তরিক উঠাবসা রয়েছে। এটা কি শরী‘আতসম্মত হচ্ছে?
অমুসলিমদের সাথে স্বাভাবিক উঠাবসায় দোষ নেই। তবে ঘনিষ্ট কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা মুশরিকদের সাথে বসবাস করো না এবং তাদের সংসর্গে থেকো না। কেননা যে তাদের সাথে বসবাস করবে অথবা তাদের সংসর্গে থাকবে, সে তাদের সমতুল্য গণ্য হবে’ (তিরমিযী হা/১৬০৫; ছহীহাহ হা/২৩৩০)। বাধ্যগত অবস্থায় তাদের সাথে উঠাবসা করতে হ’লে নিজ ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলবে এবং সুযোগমত তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিবে’ (নাহল ১৬/১২৫)। আর সর্বাবস্থায় তাদের সাথে সদাচরণ ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখবে (মুমতাহিনাহ ৬০/৮)।
কোন মেয়ের নাম যুনায়রাহ রাখা যাবে কী?
যুনায়রাহ-এর মূল উচ্চারণ যুন্নায়রাহ। যা আরবী শব্দ। এর অর্থ দীর্ঘ ও বিশালদেহী নারী, ছোট মাছি, ছোট পাথর ইত্যাদি (তাহযীবুল লুগাত ১৩/১৩১ প্রভৃতি)। যিন্নীরাহ নামে একজন মহিলা ছাহাবী ছিলেন যাকে আবুবকর (রাঃ) দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন (ইবনু হাজার, আল–ইছাবাহ ৮/১৫০; যাহাবী, সিয়ার ১/১৭৬)। সুতরাং উক্ত নাম রাখায় আপত্তি নেই।
রাসূল (ছাঃ)-কে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে যেসব মিছিল সমাবেশ হয় সেগুলোতে অংশগ্রহণ করা জায়েয হবে কি?
যদি জনগণের ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি না হয় এবং লোক চলাচলে ব্যাঘাত না ঘটে, তবে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসাবে এতে অংশগ্রহণ করা যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, অন্যায় কিছু দেখলে তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করবে, নইলে যবান দিয়ে, নইলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এটি হ’ল দুর্বলতম ঈমান’ (মুসলিম হা/৪৯; মিশকাত হা/৫১৩৭)।
পাগড়ীর ন্যায় টুপির উপরও মাসাহ করা যাবে কী?
ওযূর ক্ষেত্রে টুপির উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। কেননা পাগড়ী পুরো মাথা আবৃত করে, যা খুলে মাসাহ করা মুছল্লীর জন্য কষ্টদায়ক। অপরদিকে টুপি মাথার একটি অংশ আবৃত করে এবং তা খুলে মাসাহ করা সহজ। সেকারণ টুপি খুলে মাথা মাসাহ করার ব্যাপারেই প্রাচীন ও পরবর্তীকালের অধিকাংশ বিদ্বান ঐক্যমত পোষণ করেছেন (ইবনু কুদামা, আল–মুগনী ১/৩৮৪; উছায়মীন, আশ–শারহুল মুমতে‘ ১/২৫৪; আলবানী, সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, ক্লিপ নং ১৯০)।
একই সাথে একাধিক ব্যক্তির জানাযা হ’লে যতজনের জানাযা হবে তত ক্বীরাত ছওয়াব পাওয়া যাবে কি?
যতজন মাইয়েত থাকবে তত ক্বীরাত ছওয়াব পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় কোন জানাযায় শরীক হ’ল এবং দাফন শেষে ফিরে এলো, সে ব্যক্তি দুই ‘ক্বীরাত’ সমপরিমাণ নেকী পেল। প্রতি ‘ক্বীরাত’ ওহোদ পাহাড়ের সমতুল্য। আর যে ব্যক্তি কেবল জানাযা পড়ে ফিরে এলো, সে এক ‘ক্বীরাত’ পরিমাণ নেকী পেল’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫১)। উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, জানাযায় যতজন মাইয়েত থাকবে অংশগ্রহণকারী তত জনের বিপরীতে ছওয়াব পাবেন (শায়খ বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/১৩৬; উছায়মীন, লিকাউল বাবিল মাফতূহ ১৪৯)।
হালীমা, সালমা, রহীমা ইত্যাদি নাম রাখার বিধান কী? এগুলি আল্লাহর গুণবাচক নাম কি?
আল্লাহর নামসমূহ সর্বদা পুংলিঙ্গ। স্ত্রীলিঙ্গে আল্লাহর কোন নাম নেই। সুতরাং এসব নাম রাখায় কোন বাধা নেই। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নাম সমূহ দু’ভাগে বিভক্ত। (১) যেগুলো কেবল আল্লাহর সাথে প্রযোজ্য যেমন কুদ্দূস (মহাপবিত্র), আহাদ (এক), ছামাদ (অমুখাপেক্ষী), জাববার (মহাশক্তিধর), রহমান (পরম দয়ালু), রায্যাক (রিযিকদাতা) ইত্যাদি। এগুলো আব্দ (বান্দা) শব্দ যোগে রাখতে হবে। কেননা এই শব্দগুলো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
(২) মালেক (অধিকারী), হালীম (ধৈর্যশীল), আযীয (ক্ষমতাশালী), রহীম (দয়ালু), হাকীম (প্রজ্ঞাবান), কারীম (অনুগ্রহশীল) ইত্যাদি। এই গুণবাচক নামগুলি ব্যাপক অর্থবোধক। অতএব এই নামগুলি দ্বারা ব্যক্তি উদ্দেশ্য করা হ’লে তাতে কোন দোষ নেই। তবে ‘আব্দ’ শব্দ যোগে ডাকাই উত্তম (ইবনুল ক্বাইয়িম, তুহফাতুল মাওদূদ পৃ. ১২৫)।
পানি উঠার ভয়ে ঈদগাহের প্রাচীর উঁচু করায় শরী‘আতে কোন বাধা আছে কি?
ঈদায়নের মুছাল্লা উন্মুক্ত ময়দানে হওয়া সুন্নাত। কারণ উত্তম স্থান হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের ছালাত আদায়ের জন্য মসজিদে নববীর পূর্বদিকে ৫০০ গজ দূরে খোলা ময়দানে ‘বুত্বহান’ সমতলভূমিতে ছালাত আদায় করেন (মুত্তাফাক ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪২৬; মির‘আত ৫/২২, ৩৭২ পৃ.)। তবে ঈদগাহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সীমানা প্রাচীর নির্মাণে কোন বাধা নেই।
বিভিন্ন চাকুরীর আবেদনের ক্ষেত্রে কাগজপত্র সত্যায়িত করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সবসময় বিসিএস ক্যাডার পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে কাগজে কোন প্রকার অনৈতিকতার আশ্রয় না নিয়ে কারো সিল বানিয়ে নিয়ে নকল স্বাক্ষর করে সত্যায়িত করা জায়েয হবে কি?
কোন অবস্থাতেই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। বরং সর্বদা ন্যায়পন্থা অবলম্বনের সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, যার আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, আমরা তাদেরকে অবশ্যই আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সাথেই থাকেন (আনকাবূত ২৯/৬৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়’ (মুসলিম হা/১০২; মিশকাত হা/৩৫২০)। মিথ্যা ছোট হোক বা বড় হোক মানুষের অন্তরে মুনাফিকী সৃষ্টি করে। তাছাড়া একটি মিথ্যা অপর মিথ্যাকে ডেকে আনে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা কথা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মিথ্যুক হিসাবে পরিগণিত হয়ে যায়’ (বুখারী হা/৬০৯৪)।
একটি বইয়ে লেখা আছে, ‘গীবত করা যিনা করার চেয়েও বড় পাপ’। এটা কি ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত?
উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ (সিলসিলা যঈফাহ হা/১৮৪৬; যঈফুল জামে‘ হা/২২০৪; মিশকাত হা/৪৮৭৪)। তবে গীবত করা বড় পাপ। আল্লাহ তা‘আলা একে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করার সাথে তুলনা করেছেন (হুজুরাত ১২; মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮২৮)।
চামড়ার মোযা ব্যতীত সাধারণ অন্যান্য মোযার উপর মাসাহ করা শরী‘আত সম্মত কি? এছাড়া জুতার উপর মাসাহ করা যাবে কি?
যেকোন মোযার উপর মাসাহ করা বৈধ। হাদীছে বিশেষ কোন মোযাকে শর্ত করা হয়নি। আরবী ভাষায় চামড়ার তৈরী মোযাকে ‘খুফ’ এবং সূতা বা কাপড়ের তৈরী মোযাকে ‘জাওরাব’ বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেমন চামড়ার তৈরী মোযার উপরে মাসাহ করেছেন (বুখারী হা/২০২; মুসলিম হা/২৭৪; মিশকাত হা/৩৯৯)। তেমনি তিনি কাপড়ের তৈরী মোযার উপরেও মাসাহ করেছেন (আবুদাউদ হা/১৫৯; তিরমিযী হা/৯৯; ইবনু মাজাহ হা/৫৫৯; মিশকাত হা/৫২৩)। এছাড়া কেউ যদি জুতার উপর মাসাহ করে ছালাত আদায় করতে চায় তাকে সেই জুতা পরেই ছালাত আদায় করতে হবে। জুতা খুলে ফেললে ওযূ টুটে যাবে (মাজমূ‘ ফাতাওয়া বিন বায ২৯/৬৯)।
সুখে-দুখে সর্বদা আল্লাহর প্রশংসাকারীরা জান্নাতে সবার আগে প্রবেশ করবে- কথাটির সত্যতা আছে কি?
উক্ত মর্মে ত্বাবারাণী আওসাত্বে একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যার সনদ যঈফ (তাবারাণী আওসাত্ব হা/৩০৩৩; মিশকাত হা/২৩০৮; যঈফাহ হা/৬৩২)। তবে সুখে-দুখে আল্লাহর প্রশংসাকারী ব্যক্তিদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় হবে আল্লাহর প্রশংসাকারীগণ (আহমাদ হা/১৯৯০৯; ছহীহাহ হা/১৫৮৪)। তাদের জন্য জান্নাতে ‘বায়তুল হাম্দ’ নির্মিত হবে (তিরমিযী হা/১০২১; ছহীহাহ হা/১৪০৮)।
ইবলীস শয়তান কি একাই মানব ও জিন জাতিকে পথভ্রষ্ট করে, নাকি তার সন্তানরা রয়েছে যারা এ কাজে তাকে সহায়তা করে?
ইবলীস শয়তান একাই নয় বরং তার গোত্র মিলে সম্মিলিতভাবে মানুষ ও জিন জাতিকে পথভ্রষ্ট করে। আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে ও তার বংশধরগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছ?’ (কাহফ ১৭/৫০)। এই আয়াত প্রমাণ করে যে, তার বংশধর রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি যদি পার, তাহ’লে সর্বপ্রথম বাজারে প্রবেশকারী হবে না এবং সেখান থেকে সর্বশেষ প্রস্থানকারী হবে না। কারণ বাজার শয়তানের আড্ডাখানা; সেখানে সে আপন ঝান্ডা গাড়ে, সেখানে সে ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা জন্ম দেয় (মুসলিম হা/২৪৫১; ত্বাবারাণী কাবীর হা/৬১১৮, ৬১৩১)। অন্যত্র এসেছে, ‘ইবলীস শয়তান সমুদ্রের পানির উপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। অতঃপর মানুষের মধ্যে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য সেখান থেকে তার বাহিনী চারদিকে প্রেরণ করে। এদের মধ্যে সে শয়তানই তার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত যে শয়তান মানুষকে সবচেয়ে বেশী ফিৎনায় নিপতিত করতে পারে। তাদের মধ্যে একজন ফিরে এসে বলে, আমি এরূপ এরূপ ফিৎনা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছি। তখন সে (ইবলীস) প্রত্যুত্তরে বলে, তুমি কিছুই করনি। তিনি বলেন, অতঃপর এদের অপর একজন এসে বলে, আমি মানব সন্তানকে ছেড়ে দেইনি, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, শয়তান এ কথা শুনে তাকে নিকটে বসায় আর বলে, তুমিই উত্তম কাজ করেছ। বর্ণনাকারী আ‘মাশ বলেন, আমার মনে হয় জাবের (রাঃ) এটাও বলেছেন যে, অতঃপর ইবলীস তার সাথে আলিঙ্গন করে (মুসলিম হা/২৮১৩; মিশকাত হা/৭১)।
‘বেহেশতী জেওর’ বইয়ে উল্লেখ আছে যে, রাতের অন্ধকারে স্ত্রী মনে করে কন্যা বা শ্বাশুড়ীর শরীর স্পর্শ করলে, সে পুরুষ তার নিজ স্ত্রীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে। ফৎওয়াটি সঠিক কি?
বেহেশতী জেওরে বর্ণিত মাসাআলাটি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। সঠিক কথা এই যে, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এধরনের অনাকাংখিত আচরণ হয়ে গেলে স্ত্রী তার উপর হারাম হবে না। কেননা একটি হারাম কাজ অপর একটি হালালকে হারাম করতে পারে না। এরূপ কাজ হয়ে গেলে তাকে খালেছ অন্তরে তওবা করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি তার শ্বাশুড়ী ও শ্যালিকার সাথে যেনা করে ফেললে তিনি বলেন যে, এ কাজের জন্য তার স্ত্রী তার উপর হারাম হবেনা’ (মুহাম্মাদ ইবনু আবী শায়বাহ, বায়হাক্বী; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল হা/১৮৮১ , ৬/২৮৮)।
গার্মেন্টসে চাকুরী করা যাবে কি? এর উপার্জন হালাল হবে কি?
গার্মেন্টসে চাকুরী করা বৈধ এবং এর উপার্জনও বৈধ, যদি উৎপাদিত পণ্যটি বৈধ হয়। তবে গার্মেন্টসে নারী-পুরুষ একত্রিতভাবে থাকলে এবং ফেতনায় পড়ার আশঙ্কা থাকলে সেখানে কাজ করা ঠিক নয়। রাসূল (ছাঃ) পুরুষদের জন্য নারীদেরকে সবচেয়ে ক্ষতিকর ফিৎনা হিসাবে উল্লেখ করেছেন (বুখারী হা/৫০৯৬; মিশকাত হা/৩০৮৫)। সেক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে। আর সেটা সম্ভব না হ’লে সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় করতে হবে … (তাগাবুন ৬৪/১৬)।
খারেজী আক্বীদার অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চাই।
খারেজীদের বৈশিষ্ট্য হ’ল, (১) তারা কবীরা গোনাহগার শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব মনে করে এবং কবীরা গোনাহগার মুমিনকে ঈমানশূন্য কাফের, হত্যাযোগ্য অপরাধী এবং তওবা না করে মারা গেলে তাদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হিসাবে গণ্য করে (শাহরস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১/১১৪ পৃঃ, ইবনু হাযম, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ২/১১৩)। (২) তারা কুরআন-হাদীছের মনগড়া ব্যাখ্যা করে। রাসূল (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম সহ সালাফে ছালেহীনের ব্যাখ্যার প্রতি মোটেই ভ্রূক্ষেপ করে না। ইবনু আববাস (রাঃ), ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) প্রমুখ বিদ্বানগণ উক্ত মত ব্যক্ত করেছেন (ফিরাক্ব মু‘আছিরাহ ১/২৭৮-২৭৯)। (৩) তারা হবে কম বয়সী, নির্বোধ ও বিচার-বুদ্ধিহীন। তারা সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলবে। কিন্তু তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না (মুসলিম হা/১০৬৬, মিশকাত হা/৩৫৩৫) (৪) অন্যদের ছালাত, ছিয়াম ও আমলসমূহকে তাদের ছালাত, ছিয়াম ও আমলের তুলনায় তুচ্ছ মনে হবে (বুখারী হা/৫০৫৮)। (৫) তারা মুসলমানদেরকে হত্যা করবে ও মূর্তিপূজারীদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দিবে (অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না) (বুখারী হা/৩৩৪৪, মুসলিম হা/১০৬৪, মিশকাত হা/৫৮৯৪)। (৬) তারা সাধারণতঃ সম্পূর্ণ মাথার চুল ন্যাড়া করে রাখবে (আবুদাউদ হা/৪৭৬৬; ইবনু মাজাহ হা/১৭৫)।
এদের লোকেরাই হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে ‘কাফের’ অভিহিত করে আলী (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল এবং মু‘আবিয়া (রাঃ) ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন।
কবরে রাসূলের ছবি দেখিয়ে কি বলা হবে ইনি কে?
কবরে রাসূল ছাঃ)-এর ছবি প্রদর্শন করা হবে মর্মে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। বরং বলা হবে, তোমাদের মাঝে যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল তিনি কে? (আবুদাউদ হা/৪৭৫৩; আহমাদ হা/১৮৬৩৭; মিশকাত হা/১৩১, ১৬৩০; ছহীহাহ হা/২৬২৮)।
রাসূল (ছাঃ) অহি প্রাপ্তির পর কখনো কি হেরা গুহায় আরোহন করেছেন?
রাসূল (ছাঃ) হেরা গুহায় অহি লাভের পর সেখানে আর গমন করেননি। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘নবুঅতের প্রাক্কালে রাসূল (ছাঃ) হেরা গুহাতে গিয়ে ইবাদত করতেন এবং তাতেই সর্বপ্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়। কিন্তু ওহী নাযিলের পর কখনও তিনি সেখানে উঠেননি, এমনকি তিনি তার নিকটবর্তীও হননি। পরবর্তীকালে তার কোন ছাহাবীও সেখানে যাননি। রাসূল (ছাঃ) নবুঅত প্রাপ্তির পর তের বছর মক্কাতেই অবস্থান করেছেন। আবার হিজরতের পর তিনি মক্কাতে কয়েকবার এসেছেন, যেমন- হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়, মক্কা বিজয়ের বছর এবং সেখানে তিনি প্রায় ২০দিন অবস্থান করেছেন, কিন্তু তিনি কখনও সেখানে যাননি। আর সেখানে না যাওয়ার কারণ হয়ত ছিল এই যে, জাহেলী যুগের লোকেরা সেখানে গিয়ে ধ্যান করত। এমনকি রাসূলের দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার সূচনা করেছিল বলেও বর্ণিত হয়েছে। ফলে যাতে মুসলমানরা উক্ত জায়গাটিকে বিশেষ মর্যাদা মন্ডিত মনে না করে, এজন্য রাসূল (ছাঃ) আর কখনো সেখানে যাননি (মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ১০/৩৯৪)।
সুন্নাতের শেষ দু’রাক‘আতে কী অন্য সূরা মিলাতে হয়?
যোহর ও আছরের ছালাতে ইমাম-মুক্তাদী সকলে সূরা ফাতিহা সহ অন্য সূরা পড়বে এবং ৩য় ও ৪র্থ রাক‘আতে কেবল সূরা ফাতিহা পড়বে। যেমন আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যোহরের প্রথম দু’রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য দু’টি সূরা পড়তেন এবং শেষের দু’রাক‘আতে কেবল সূরা ফাতিহা পড়তেন।… অনুরূপ করতেন আছরে…’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৮২৮)। একই নিয়মে চার রাক‘আত সুন্নাতের শেষ দু’রাক‘আতে পড়বে। তবে শেষের দু’রাক‘আতেও কোন কোন ছাহাবী সূরা মিলাতেন বলে জানা যায় (মুওয়াত্ত্বা হা/২৬০; মির‘আত ৩/১৩১)। জানা আবশ্যক যে, ফরয-নফল সব ছালাতে সূরা ফাতিহা ব্যতীত অন্য সূরা পাঠ করা ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) বলেন, কোন ছালাত সিদ্ধ নয় সূরা ফাতিহা ব্যতীত (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৮২২)।
সূরা কাওছারে রাসূল (ছাঃ)-কে কুরবানী করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষণে কুরবানী করা কি ফরয?
কুরবানী করা ফরয নয়। বরং সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। তাই সামর্থ্যবানদের জন্য এটা পালন করা যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে’ (আহমাদ, ইবনু মাজাহ, হাকেম; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৩২; এটি ওয়াজিব নয় যে, যেকোন মূল্যে প্রত্যেককে কুরবানী করতেই হবে। লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব, ওমর ফারূক্ব, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীগণ কখনো কখনো কুরবানী করতেন না (বায়হাক্বী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১৩৯; মির‘আত ৫/৭২-৭৩; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৫/১০)।
বৃটিশ আইনে পরিচালিত বাংলাদেশের কোন আদালতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করা শরী‘আতসম্মত হবে কি?
আদালত ব্যবস্থাপনা সমাজের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। সেকারণ আদালতের যেকোন চাকুরী বৈধ। তবে সেখানে সর্বদা সত্যকে বিজয়ী করা, যুলুমের প্রতিরোধ করা এবং মানুষকে তার হক ফেরত দেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। যাতে কোন নিরপরাধ ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হয় এবং অপরাধী ছাড়া না পায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নেকী ও আল্লাহভীরুতার কাজে পরস্পরকে সাহায্য করে এবং পাপ ও শত্রুতার কাজে সাহায্য করো না’ (মায়েদাহ ৫/০২; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ১৯/২৩১)। আর ইসলামী আইনের বিপরীতে প্রচলিত বৃটিশ আইনের দায়ভার বর্তাবে সরকারের উপর। যতদিন তা চালু থাকবে, ততদিন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ পাপী হ’তে থাকবে। কেননা আল্লাহর বিধানের বিপরীতে অন্যের বিধান কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় (ইউসুফ ৪০, মায়েদাহ ৫০ প্রভৃতি)।
আমরা জানি আল্লাহর দু’হাতই ডান হাত। তবে মিশকাতে একটি হাদীছে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর ডান ও বাম দু’হাতই রয়েছে। কোনটি সঠিক?
আল্লাহর দু’হাত রয়েছে এবং ডান ও বাম হাতও রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আকাশমন্ডলী পেঁচিয়ে নিবেন। তারপর তিনি আকাশমন্ডলীকে ডান হাতে ধরে বলবেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় শক্তিশালী লোকেরা! কোথায় অহংকারীরা? এরপর তিনি বাম হাতে গোটা পৃথিবী গুটিয়ে নিবেন এবং বলবেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় অত্যাচারী লোকেরা, কোথায় বড়ত্ব প্রদর্শনকারীরা?’ (মুসলিম হা/২৭৮৮; মিশকাত হা/৫৫২৩)। অত্র হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর ডান ও বাম হাত রয়েছে। তবে তা সৃষ্টজীবের মত নয়। অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টজীব বাম হাত দ্বারা সাধারণত দুর্বল বা অপরিষ্কার কাজগুলো করে থাকে। সে অর্থে আল্লাহর দু’হাতই ডান হাত। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ন্যায়বিচারকগণ (ক্বিয়ামতের দিন) আল্লাহর নিকটে নূরের মিম্বর সমূহে মহিমান্বিত দয়ালু (আল্লাহ্)-এর ডানপার্শ্বে উপবিষ্ট থাকবেন। আর তার উভয় হাতই ডান হাত (অর্থাৎ সমান মহিমান্বিত)। (সেই ন্যায়পরায়ণ হচ্ছে) ঐসব লোক, যারা তাদের শাসনকার্যে, তাদের পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে এবং তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব সমূহের ব্যাপারে সুবিচার করে (মুসলিম হা/১৮২৭; মিশকাত হা/৩৬৯০)। অর্থাৎ সম্মান-মর্যাদা, ক্ষমতা ও দোষ-ত্রুটির ক্ষেত্রে সৃষ্টজীবের বাম হাতের সাথে তাঁর হাত তুলনীয় নয় (বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৫/১২৬; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১/১৬৫)। অতএব হাদীছ দু’টির মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
কারো বিরুদ্ধে যেনার অপবাদ দিলে এবং তা প্রমাণিত না হ’লে শরী‘আতে অভিযোগকারীর জন্য কি শাস্তি রয়েছে?
মিথ্যা অপবাদ হ’ল কারো ব্যাপারে অন্যের নিকটে এমন কথা বলা যা তার মাঝে নেই (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮২৮)। কারো উপর যেনার অপবাদ দিয়ে প্রচার করা কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আর মিথ্যা অপবাদ দানকারীর শাস্তি হ’ল ৮০ বেত্রাঘাত। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেয়। অথচ চারজন (প্রত্যক্ষদর্শী) সাক্ষী হাযির করতে পারে না। তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর। আর তোমরা কখনোই তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। বস্ত্ততঃ এরাই হ’ল পাপাচারী’ (নূর ২৪/৪-৫)। ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এ ব্যাপারে ঐক্যমত রয়েছে যে, সতী-সাধ্বী নারীর উপর অপবাদ দেওয়ার শাস্তি পুরুষের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে (ফৎহুল বারী ১২/১৮১)। উল্লেখ্য, শরী‘আত নির্ধারিত দন্ডবিধি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের, অন্যদের নয় (কুরতুবী)।
পরবর্তীতে মূল্য বৃদ্ধির আশায় আলু-পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য স্টক রাখার ব্যাপারে শরী‘আতের বিধান কি?
বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করা হারাম। মা‘মার (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি বেশী দামের আশায় সম্পদ জমা রাখে সে পাপী (মুসলিম হা/১৬০৫; আবূদাঊদ হা/৩৪৪৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, মূল্যবৃদ্ধির আশায় অপরাধী ব্যতীত আর কেউ খাদ্য-শস্য মওজুদ করে না (মুসলিম হা/১৬০৫; ইবনু মাজাহ হা/২১৫৪)।
উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময় যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য ক্রয় করে এবং তখন বিক্রি না করে অধিক মূল্য বৃদ্ধির আশায় তা সঞ্চিত রাখে, সে ব্যক্তি পাপী হবে। তবে যদি তা খাদ্যশস্য না হয়, তবে তাতে দোষ নেই (শরহ নববী)। অতএব পেঁয়াজ ও লবন মওজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীরা তওবা করুন।
তবে সাধারণভাবে উৎপাদনের মৌসুমে হ্রাসপ্রাপ্ত মূল্যে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে অন্য মৌসুমে প্রচলিত বাজারমূল্যে বিক্রয় করায় কোন দোষ নেই। কেননা খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হ’লে তা জায়েয (আওনুল মা‘বূদ ৫/২২৬-২২৮ পৃঃ, ‘ইহতেকার নিষিদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; নায়ল, ৫/২২২ পৃঃ, ‘ইহতেকার’ অনুচ্ছেদ)।
আমার পৈত্রিক সম্পদের বেশ কিছু অংশ আমার কতিপয় আত্মীয়-স্বজন অবৈধভাবে ভোগ করছে। এখন তা ফিরিয়ে নিতে গেলে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা শরী‘আতে নিষিদ্ধ। এক্ষণে সম্পদ না আত্মীয়তা কোনটিকে অগ্রাধিকার দিব?
সম্পদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ফিরিয়ে নিতে হবে। আবার আত্মীয়তার বন্ধনও রক্ষা করতে হবে। আর এ বিষয়ে উভয় পক্ষকে সহনশীল হতে হবে। নইলে হঠকারী পক্ষ দায়ী হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কারু এক বিঘত জমি অন্যায়ভাবে দখল করবে, ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক যমীনের বেড়ী পরানো হবে (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/২৯৩৮)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অন্যায়ভাবে ভোগ করা সমস্ত মাটি তার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে তা বহন করতে বাধ্য করা হবে (আহমাদ, মিশকাত হা/২৯৫৯)।
প্রথম কাতারে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব কি? মসজিদে যদি কেবল একটিই কাতার থাকে সেক্ষেত্রে উক্ত মর্যাদা পাওয়া যাবে কি?
প্রথম কাতারে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব অত্যধিক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষ যদি জানত আযানে এবং প্রথম কাতারে কি নেকী রয়েছে। তাহ’লে লটারীর মাধ্যমে হ’লেও আযান দেওয়ায় ও প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর জন্য অংশগ্রহণ করত’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬২৮ ‘ছালাতের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ)। তিনি বলেন, ছালাতের প্রথম কাতার ফেরেশতাদের কাতারের মত। তোমরা যদি প্রথম কাতারের ফযীলত জানতে তাহ’লে অবশ্যই দৌঁড়ে যেতে (আবূদাঊদ হা/৫৫৪; মিশকাত হা/১০৬৬)। তিনি বলেন, প্রথম কাতারের (মুছল্লীদের) উপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন’ (ইবনু মাজাহ হা/৯৯৭)। তিনি আরো বলেন, ‘পুরুষদের জন্য সর্বোত্তম কাতার হ’ল প্রথম কাতার’ (মুসলিম হা/৪৪০; মিশকাত হা/১০৯২)। এক্ষণে মসজিদে কেবল একটি কাতার থাকলেও সেটি প্রথম কাতার হিসাবে গণ্য হবে এবং এর যাবতীয় ফযীলত অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। কেননা প্রথম কাতার বলতে ইমামের পিছনের কাতারকেই বুঝানো হয়েছে (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ২/২০৮)।
নতুন বাড়ীতে ওঠা উপলক্ষে আনুষ্ঠান করা যাবে কি?
নতুন বাড়ী আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা শরী‘আত সম্মত নয়। কেবল বিসমিল্লাহ বলে উঠবে। আর শয়তানের ক্ষতি হ’তে বাঁচার জন্য যেকোন সময় সূরা বাক্বারাহ বা তার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করা যাবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বাড়ীকে কবরে পরিণত করো না। নিশ্চয়ই শয়তান এমন বাড়ী থেকে পালায়, যে বাড়ীতে সূরা বাক্বারাহ পড়া হয়’ (মুসলিম হা/৭৮০; মিশকাত হা/২১১৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে বাড়ীতে (বা অন্যত্র) তিন রাত সূরা বাক্বারাহর শেষ দুই আয়াত পাঠ করা হয়, শয়তান সে বাড়ীর নিকটবর্তী হয় না’ (তিরমিযী হা/২৮৮২; মিশকাত হা/২১৪৫)।